বিচারপতি নিয়োগে আইন ও রাজনীতির লড়াই


এরশাদুল আলম প্রিন্স
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নতুন চারজন বিচারপতি নিয়োগ করেছেন। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ দফা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগ দান করেছেন।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করায় সংবিধানের ৫৪ ধারার ক্ষমতা  বলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি স্পিকার আব্দুল হামিদ এ নিয়োগ দান করেন।

সংবিধানের বিধান মোতাবেক, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া এ নিয়োগদান করার ক্ষমতা রাখেন না। তিনি শুধু প্রধান বিচারপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন মতামত প্রয়োগ করতে পারেন।

কিন্তু এ দুটো নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি আসলে কতটুকু স্বাধীন, সে আলোচনা পরের কোনো লেখায় করার আশা রাখি। বর্তমান লেখায় কেবল নতুন যে চারজন বিচারক নিয়োগ করা হলো, শুধুমাত্র তার ওপরেই আলোকপাত করবো।

যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান বিভাগ হলো- আইনসভা, শাসন বা নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। 

শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণে এ তিনটি বিভাগের শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা অবশ্য জরুরি।

রাষ্ট্রে তিনটি বিভাগেরই পৃথক কর্মপরিধি রয়েছে এবং তারা ক্ষমতার দিক থেকে স্বতন্ত্র বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ। তবে ক্ষমতার প্রশ্নে তারা পুরোপুরি পৃথক নয়, সম্ভবও নয় এবং প্রয়োজনও নয়।

গণতন্ত্রে এই তিনটি বিভাগের মধ্যেই ক্ষমতার এক ধরনের ভারসাম্য বিরাজমান করে থাকে। পরিপক্ক গণতন্ত্রে এমনটিই হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো সেটি হয়ে ওঠেনি। বরং এখানে বিরাজ করে গণতন্ত্রের অজুহাতে এক বিভাগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য বিভাগের অনুপ্রবেশ বা হস্তক্ষেপ। এ বিষয়টি আগে নীরবে হতো।  আর এখন হচ্ছে জানান দিয়ে।

নতুন চার বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে বিচার বিভাগের অভ্যন্তরে নির্বাহী বিভাগের চরম হস্তক্ষেপের আরেকটি নজির সৃষ্টি হলো।

আরেকটি নজির বলছি এ কারণেই যে, ইতোপূর্বেও এ রকম নজির সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউ কারো চেয়ে এ কাজ কম করেনি।

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ রাষ্ট্রপতির জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে পালনীয় বিধায় একদিকে প্রধানমন্ত্রীকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে আরও সংকুচিত করে তার পদটিকে একটি জায়নামাজ ও মোনাজাত সর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ একটি পদে পরিণত করেছে।

কাজেই বর্তমানে যে বলা হচ্ছে, চলমান সংকট উত্তরণে একজন সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতির খুব প্রয়োজন; সেটি আসলে একটি উচ্চবাচ্য (Rhetoric) ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে ক্ষমতা হস্তান্তরের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির যে রকম ভূমিকা ছিল, বর্তমান সংশোধনীর আওতায় তার সে ভূমিকা পালন করার সুযোগই নেই।

কারণ, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই, যেখানে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।

কাজেই যেভাবেই বলি, প্রধানমন্ত্রী যে সব কিছুর নিয়ন্তা, সে বিষয়টি নিশ্চিত। সংবিধান পরিবর্তনও হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী। আপিল বিভাগে চার বিচারক নিয়োগ যে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন, তাতে আর সন্দেহ কী!

অতিসম্প্রতি, আমরা বিচার বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে এক প্রকাশ্য দন্দ্ব দেখতে পেয়েছি। যেটি বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় খুবই স্বাভাবিক। কারণ, আগেই বলেছি, আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে একটি বিভাগ নিজেদের দায়িত্ব পালনের প্রতি যতটা না যত্মশীল তার চেয়ে শতগুণ সোচ্চার অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে। এ ক্ষেত্রে কেউ কারো চেয়ে কম নয়।

আর এ রকমটি হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। গণতন্ত্র যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে কিংবা রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো যেখানে পেশাদারিত্বের ওপর দাঁড়িয়েছে, সেখানে এ রকম হয় না।  

স্মর্তব্য, আদালতের এজলাসে একজন বিচারকের মন্তব্য আমলে নিয়ে জাতীয় সংসদ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে সেই বিচারপতির অভিসংশনের কথাও ওঠে। পরে অবশ্য স্পিকার বিষয়টির নিষ্পত্তি করেন। কিন্তু, বিষয়টি নিয়ে আইন ও বিচার বিভাগ যেভাবে মুখোমুখি অবস্থান নেয়,তাতে রাষ্ট্রীয়  কাঠামোর দুর্বলতাই প্রকাশ পায়; যেটি দুটি বিভাগেরই অপেশাদারী মনোভাবের পরিচায়ক।

একজন বিচারপতির একটি মন্তব্য নিয়ে সংসদে আলোচনা করা সংসদীয় রীতিনীতির পরিপন্থি। এটি হওয়ার কারণ হলো, আমাদের গণতন্ত্র এখনও পরিপক্ক হয়নি। পাশাপাশি, আমাদের বিচারকরাও ভুলে যান যে, তারা কেবল একজন ব্যক্তি-বিচারকই নন, তারা একেকটি প্রতিষ্ঠান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তাদের একটি মন্তব্য আমাদের জন্য আদেশ। তাদের একটি কথার তাৎপর্য ব্যাপক। কাজেই বেফাঁস কথা বলা রাজনীতিকদের কাজ, বিচারকদের নয়।

কিন্তু, আশ্চর্য দেখুন, যে বিচারককে নিয়ে সংসদের এত  সংবেদনশীলতা, তৎকালীন মাননীয় স্পিকার ও বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি কিনা তাকেই আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করলেন! এ থেকেই বোঝা যায় যে, আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে নীতিগত বিরোধ বা মিলন দেখা যায়, তার সঙ্গে ন্যায়নীতি ও আইন-কানুনের সম্পৃক্ততা থাকে না। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থই সেখানে মুখ্য। মাঝখানে আমরা জনগণ অহেতুক তর্কে লিপ্ত হই।  

যদি সেদিনকার সেই বিচারপতিকে তার মন্তব্যের জন্য নিন্দা করতে হয়, তবে আজকের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেন কী করে?  সেটাও সম্ভব হতো, যদি তালিকায় ওই বিচারপতি ওপরেই থাকতেন। কারণ, যোগ্যতাকে তো পুরস্কৃত করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্নটি হলো, তিনি কি এতই যোগ্য যে, তার কয়েকজন ওপরে যাদের অবস্থান, তাদের ডিঙিয়ে তাকেই বিচারপতি করতে হবে?

যদি সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নিই, তবে তো আমাদের এও মেনে নিতে হয় যে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি ওই বিচারপতির নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কারণ, এ বিষয়ে আমাদের হাতে মামলার নজির আছে।  

রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ ও পদোন্নতির ইতিহাস আমাদের দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ইতিহাসের সমসাময়িক। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রর্বতনের পর এ প্রক্রিয়া আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

১/১১-র সৃষ্টি বা দুই বছরের জন্য গণতন্ত্রের অগস্ত্যযাত্রা সেও সেই রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক নিয়োগের কারণেই। কারণ, সরকারের ছকে বাধা পথে নির্বাচনের সময় তাদের ঘরানার বিচারক যেন গদিনশীন থাকে, সে ফর্মূলা অনুযায়ী আপিল বিভাগে নিয়োগ বা পদোন্নতি দান করাই সরকারের ধান্ধা থাকে। কিন্তু বিরোধী দল সে জালে পা দেবে কেন?  ফলে, দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বিপন্ন হয়। নির্বাচন বানচাল হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার হস্তান্তর হয়না। মাঝখান দিয়ে দেশের বিচার বিভাগ নিপতিত হয় এক চরম সংকটে। মানুষ আস্থা হারায় বিচার বিভাগের ওপর। এই হলো আমাদের রাজনীতি- যেখানে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বলি হয় বিচার বিভাগ।  

আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ বা বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পেছনেও প্রয়োজন বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা থাকে বেশি। যেমন ইতোপূর্বে আপিল বিভাগে মামলা-বিবেচনায় বিচারক বাড়ানো হয়নি, বাড়ানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করার জন্য।

বিচারকরা যেভাবে বিব্রত হতে থাকলো, তাতে পুরো জাতিই বিব্রত হয়েছিল। অতঃপর আইন করে বিচারক সংখ্যাও নির্দিষ্ট করা হলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে সংখ্যক বিচারক নিয়োগ হলো, সে অনুপাতে মামলা জট খুললো না। অর্থাৎ জনগণের ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এ অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ তেমন কোনো সুফল বয়ে আনতে পারলো না।

বর্তমান চার বিচারকের নিয়োগের প্রেক্ষাপটটিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধ আদালতের সদ্য রায়প্রাপ্ত আপিলগুলো আপিলের জন্য এ বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য সৎ। কিন্তু, তাই বলে বিচারক নিয়োগের রেওয়াজ ভেঙে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে? সরকারের এ সিদ্ধান্ত আদতে জাতির জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না।  

সরকার ঠিকই বলছে, নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘন হয়নি। আমরাও তাই বলছি। কিন্তু সংবিধানের বাইরেও রীতিসিদ্ধ আইন বা রেওয়াজ বলতে একটি বিষয় আছে, যেটি আমাদের বিচার বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ  করে আসছিল। 

বলে রাখা ভালো, আইনের অন্যতম একটি উৎস হলো রীতি বা প্রথাগত আইন (customary law)। যদি ধরেও নিই, সংবিধানের লঙ্ঘন হয়নি, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন কোন বিবেচনায় সিনিয়রদের ডিঙিয়ে জুনিয়রদের নিয়োগ করতে হবে? সরকারকে সে বিষয়টিও পরিষ্কার করতে হবে। বিচার বিভাগের মতো একটি স্পর্শকাতর বিভাগ নিয়ে জাতির মনে কোনো প্রশ্ন বা ধোঁয়াশা সৃষ্টি ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক নয়। 

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বিচারপতি আনোয়ারুল হককে। তিনি হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারক। বিচারপতি হাসান ফয়েজ ও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীও ২০০১ সালেই নিয়োগপ্রাপ্ত।

বিএনপি আমলে স্থায়ী হয়েছিলেন কেবল বিচারপতি আনোয়ারুল হক। যাই হোক, বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়ার পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচ্য।

আদালতের আদেশে ২০০৯ সালে চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন ১০ বিচারক যাদেরকে আগে স্থায়ী করা হয়নি। কিন্তু, একই বিবেচনায় বিএনপি আমলের আরও ২০ জনের মামলা খারিজ করে দিয়েছে আদালত।   

আমরা একদিকে এক বিচারককে অসদাচরণের জন্য ভর্ৎসনা করি, অন্যদিকে ৩৮ জন বিচারককে ডিঙিয়ে তাকেই পদোন্নতি দিই। কোনটিকে জায়েজ বলবো আর কোনটিকে না জায়েজ?

আমরা এখনও ভুলে যাইনি বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বর্তমান বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় তখন তিনবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্ত তারও আগে তিনিই রায় দিয়েছেন, শুধু জ্যেষ্ঠতা নয়, মেধাও বিবেচ্য…ইত্যাদি। কাজেই সে বিচারেই হয়ত বিএনপি সরকার তাকে বাদ দিয়েছিল! আদালতের রায়তো শিরোধার্যই বটে! গল্প এখানেই শেষ নয়। কিছুদিন আগে তাকেই যুদ্ধাপরাধ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে লড়ার জন্য প্রধান আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দান করেছে সরকার। কাজেই, বিচার বিভাগের দলীয়করণ এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। নিয়োগ-পদোন্নতি সবক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনা। এই রাহুগ্রাস থেকে জাতির মুক্তি প্রয়োজন।

লেখক- আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক, বাংলানিউজ, মেইল: ealamlaw@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

Source: http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=dfdd7398c6eaccc72360eaea6b353ab3&nttl=03042013186248